রক্তগ্যান্ধা
রক্তগ্যান্ধা
‘‘দাদু”।
ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে তমা এসে আফজাল সাহেবের গায়ে ধাক্কা দেয়।
আফজাল সাহেব তখনো বিছানায় শুয়ে আছেন। কপালে হাত রেখে এতক্ষণ অতীত জীবন সম্পর্কে ভাবছিলেন। তমার আহবানে তিনি বালিশ থেকে মাথা তোলেন।
‘‘কিছু বলবে
দাদু ভাই?”
“আমাকে একটি ইয়াবড় মালা গেথে দাও না দাদুভাই।” দুহাত প্রসারিত করে তমা আফজাল সাহেবের কাছে আবদার জানায়।
“এত ভোরে মালা দিয়ে কি করবে দাদুভাই? আমাকে বরণ করবে বুঝি?” তিনি দুষ্টুমীভরা চোখে তমার কাছে জানতে চান।
“ছি, দাদু! আজ ওকথা বলতে নেই। আজ না একুশে ফেব্রুয়ারী? মহান ভাষা শহীদ দিবস। তুমি একেবারে
বোকা- কিছুই খবর রাখো না । দাও- জলদি মালাটা
গেথে দাও। আমি সবার আগে শহীদ মিনারে দিব।”
আফজাল
সাহেব তমার ভৎসনায় অপ্রস্তুত হেয়ে পড়েন। আজ শহীদ দিবস!তিনি আবাক হন। তারপর আচ্ছন্নভাবে
তমার হাত থেকে ফুল, শুতা আর সূচ তুলে নেন। তারপর বলেন-“হ্যারে দাদুভাই, আমাকে শহীদ
মিনারে নিয়ে যাবিনা?”
‘‘ধেৎ.
তুমি যাবে কি করে? তুমি তো পঙ্গু। আমরা সবাই যাব আর তুমি এখানে বাসা দেখাশুনা করবে।”
তমা যেন খুব মজা পায়।
“হ্যাঁ,
পঙ্গুইতো।” তিনি একটি দীঘশ্বাস ফেলেন।
স্যাটেলাইটের
মতো তার হৃদয় স্ক্রীনে বহুবছর আগের চিত্র ফুটে ওঠে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী, ভাষার
জন্যে সারা বাংলাদেশে হটতাল। আফজাল সাবেব তখন ঝিনাইদহ কলেজের ১ম বর্ষেরে একজন ছাত্র।
বাড়ী শৈলকুপায়। বোনের বাসায় থেকে লেখাপড়া চালাতেন। ভাষা আন্দোলনের কখা তিনি আগেই শুনেছিলেন:-
পাকিস্তানের উষালগ্ন থেকেই
পশ্চীম পাকিন্তানী শাসক মহল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধুঁয়ে মুছে ফেলার অপপ্রয়াসে
তথা ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। আর এ ষঢ়যন্ত্র আঁচ করতে পেরেই বাংলার বুদ্ধিজীবীগন পাকিন্তান
জন্মের মাত্র আঠারো দিন পর অথা©ৎ
১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মরহুম আবুল কাসেমের উদ্দ্যোগে
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে তাঁর আজিমপুরস্থ ১৯ নং বাসায় ‘তমুদ্দুন মজলিস’ গঠন করেন।
অবশ্য এর আগেই ১৯২০ সালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছিলেন।
যাহোক
১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারীতে গনপরিষদের প্রথম অধিবেশনে c~e© বাংলার
সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ-এর বাংলা ভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবে কায়েমী স্বার্থবাদী
মহল যখন বিরোধীতা করে তখন পূe© বাংলার জনগন পরিস্কার বুঝতে পারে শয়তান পশ্চীমা
শাসক মহলের মাথায় কূটিল চক্রান্ত রয়েছে। এরা বাংলার মঙ্গল চায় না। চায় বাংলার বিপুল
সম্পদ। ফলে ছাত্রসমাজ মিছিল, ধর্মঘট করে।আফজাল সাবেব তখন বেশ ছোট। তবে ভাষা সংগ্রামের
ঢেউ তাকেও পলকিত করেছিল-তার রক্তে আন্দোলনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। মনে মনে আন্দোলনে
যোগদান করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের
আশ্বাসে আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে। এরপর ২১শে মার্চ ও ২৪শে মার্চ যখন যথাক্রমে রেসকোর্স ময়দানে ও লর্ড
কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভY©i জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ-
যে কিনা দ্বি-জাতি তত্ত্বে ধর্মের মহাত্ম দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “মুসলমানেরা ভাই
ভাই। আমরা পরস্পর সাম্য ও ভ্রাতৃ্ত্তের বিশ্বাসের ভিত স্থাপন করে সুখের স্বM© রচনা
করব।” সেই জিন্নাহ আজ কি বলছে! ছাত্ররা তার চাতুরীপূর্ণ কথায় প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে
পড়ে।
এরপর
১৯৫০ সালে লিয়াকত আলী খানও একই ভাষ্য দেন। বাংলার মানুষের আশ্বাস প্রদানকারী খাজা নাজিমুদ্দীনও
গঃ জেনারেল হবার পর ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারীতে ভাষ্য দেন- “উর্দুই হবে পাকিস্তানের
একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।”
এতে
বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল ও আপামর জনতা বিদগ্ধ অভিমান ও আক্রোশে বাকহীন হয়ে পড়ে। নাজিমুদ্দীনের
পূর্ব আশ্বাস যে রাজনৈতিক কৌশল তা বাংলার মানুষ দিবালোকের মত পরিস্কার বুঝতে পারে।
ফলে
৩০শে জানুয়ারী ঢাকায় ধর্মুঘট পালিত হয়। সেদিনও আফজাল সাহেবের খুব ইচ্ছা হয়েছিল ধর্মঘঠে
যোগ দেবার। কিন্তু ঝিনাইদহে অবস্থান করাই তা পারেনি।কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ঠিকই
যোগ দিয়েছিলেন।
২১শে
ফেব্রুয়ারী, প্রদেশব্যাপী সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ধর্মঘট ও মিছিলের আহবান
শুনে আফজাল সাহেবের তরুন রক্ত আবারও টগবগিয়ে উঠেছিল। অরুদ্ধ আবেগ নিয়ে তিনি ২০ ফেব্রুয়ারী
ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন এবং রাত্রে ঢাকায় পৌঁছান। উঠেছিলেন তার এক ফুফুর বাসায়। রাতের
অবশিষ্ট প্রহর কেটেছিল তার নির্ঘুম ও চরম উত্তেজনায়। এসময় সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে।
তারপর-
তারপর
আফজাল সাহেব তার পঙ্গু ডান পায়ে একটা সহানুভূতির পরশ বুলায়। জলে ভরা আখি পল্লব মুঁদে
আবার স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান:-
২১শে
ফেব্রুয়ারী- সমস্ত ঢাকা চরম উত্তেজনা ও আক্রোশে গরম। আফজাল সাহেব রাস্তায় নামেন। জনগনের
ঢল ঠেলে ধীরে ধীরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এদিয়ে যান। কিছুদুর যাবার পর তিনি
শুনতে পান-
মায়ের
ভাষা, বাবার ভাষা,
বাংলা
ভাষা, বাংলা ভাষা,
আমার
ভাষা, তোমার ভাষা,
বাংলা
ভাষা, বাংলা ভাষা।
তারপর আবার শোনা যায়-
রাষ্ট্রভাষা,
রাষ্ট্রভাষা,
বাংলা
ভাষা, বাংল ভাষা।
আফজাল
সাহেবের মস্তিস্কের প্রতিটি কোষে যেন শিহরনের আগুন লেগে যায়। তিনি আচ্ছন্নের মত মিছিলের
দিকে এগিয়ে যান। মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল সামনেই। তাঁর ছোটার গতি আরো দ্রুত হয়। কিন্তু
সরকরী আর্মার গাড়িটা তাকে আর অগ্রসর হতে দেয় না। আ! সে কি দুঃস্বপ্ন! বিশাল গR©নে বিশাল
গাড়িটা আফজাল সাহেবের পায়ের উপর দিয়ে মিছিলের দিকে এগিয়ে যায়।
আফজাল
সাহেব তার রক্তে সিক্ত শক্ত পিচঢালা রাস্তার উপর পড়ে থাকেন এবং অচেতন ভাবে বলতে থাকেন-
“মায়ের
ভাষা, আমার ভাষা,
রাষ্ট্রভাষা
বাংলা ভাষা।”
তারপরই
আফজাল সাহেবের ডান পা-টা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। হাসপাতাল থেকেই তিনি শুনেছিলেন মিছিলের
উপর পুলিশ অবY©bxয় বর্বরতা চালিয়েছে।মিছিলের উপর হায়েনার দল গুলি
চালিয়েছে। যার ফলে রফিক, শফিক, ছালাম, বরকত, জব্বার ও আরো নাম না জানা বাংলার অকুতোভয়
দামাল সন্তান প্রান দিয়েছে।
তমা
মালা নিয়ে অনেক আগেই চলে গেছে। আফজাল সাহেবের দু’চোখ আবার এক স্বর্গীয় আবগাশ্রুতে ভরে
ওঠে। তিনি পরম মমতা ও শ্রদ্ধাভরে শহীদ ভাইদের কথা স্মরন করেন। তার বড় সাধ হয় একটা লাল
টকটকে পলাশ রাঙা ফুলের মালা শহীদ মিনারে নিবেদন করতে। কিন্তু শহীদ মিনার তো অনেক দুরে।
পঙ্গু মানুষ অতো দুরে যাবে কি করে। হঠাৎ তার ক্রাচের কথা মনে পড়ে। হাতটা বাড়িয়ে দেন
খাটের কিনারে। না নেই। কাজের মেয়েটা ঘর পরিস্কার করতে এসে দেয়ালের কোণে রেখে গেছে।
কি করবেন তিনি ভাবতে থাকেন। বাসায় কেউ নেই যে তাকে ক্রাচটা এনে দিবে। কিন্তু তাকে যে
যেতেই হবে। তিনি বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করেন। হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে ফ্লোরের বহুমূল্য
কার্পেটের উপর পড়েন। বহুকষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে, ক্রল করে দেয়ালের কোণে পৌছান। ক্রাচটি
হাতে তুলে নেন। তারপর আবার মালার কথা মনে পড়ে। একটি মালা হলে খুব ভালো হত। তিনি ঘরের
চারদিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকান। কার্পেটের উপর কয়েকটি রক্তগ্যান্ধা চোখে পড়ে তার বকের
মধ্যে আনন্দধারা ছলকে ওঠে। তমার মালা গাঁথার সময় মনে হয় ওগুলো পড়ে গিয়েছিল। তিনি খুবই
খুশী হন।
ক্রাচে
ভর দিয়ে ধীরে সুস্থে তিনি ফুলগুলোর কাছে গিয়ে বসেন। হৃদয় আঙিনার গহীনে লালিত সমগ্র
চেতনা, বাসনা, একাগ্রতা ও অপার মমতা দিয়ে তিনি একটি ছোট্ট মালা গাঁথেন।
মালা
হাতে নিয়ে তিনি উঠান পেরিয়ে রাস্তায় নামেন। বহুদিন পর মুক্ত ঝিরঝিরে বাতাস তার জ্বরাক্লিষ্ট
শরীরে শান্তির পরশ জানায়।
দুর
থেকে ভেসে আসছে-“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলতে পারি …… ।”
অশ্রুসিক্ত
নয়নে দাড়িয়ে তিনি গানটি শোনেন। তার শরীরে এক ধরনের উদ্দামতা তার শরীরে আছড়ে পড়ে। ৫২
সালের সেই দিনের মতই তিনি আজও বিপুল উদ্দ্যোমে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে চলেন। কিছুদুর
যেয়েই তিনি হাফিয়ে ওঠেন। বয়সের ভারে শরীরে এক অসঢ়তা আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু যেতে যে তাকে
হবেই।
বাচ্চা
ছেলের মত তিনি এক পা, এক পা করে ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি হাটতে থাকেন। শহীদ মিনারের কাছে
প্রচন্ড ভীড়। জন ব্যারিকেড ভেদ করে তিনি ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন না। কিছুটা সময় বিশ্রাম
নেন দাড়িয়েই। তারপর আবার চেষ্টা করেন।
আস্তে
আস্তে ক্রাচ ঠেলে জনসমুদ্র বেষ্ঠিত শহীদ মিনারের কাছে তিনি এগিয়ে যান। ভ্যাবসা গরমে
তার শরীর ঘেমে ওঠে। ইস্ মানুষের শরীরে কি উত্তাপ! অসহ্য কষ্ট হয় তার। তবুও তিনি এগুতে
থাকেন। হঠাৎ কারো সজোর ধাক্কায় তিনি মিনারের লৌহকঠিন সিঁড়ির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ক্রাচটা
হাত থেকে ছিটকে
দুরে
পড়ে থাকে। আফজাল সাবেব্ও ওটা আর খোঁজার চেষ্টা করেন না। তার মধ্যে ওঠার আর কোন লক্ষণ দেখা যায় না। তিনি আর ওঠেন না।
এতক্ষণে
লোকজন লক্ষ্য করে পঙ্গু, মলিন, শশ্রুমন্ডিত একজন বৃদ্ধ শহীদ মিনারের বেদীমূলে পড়ে আছে।
তার হাতে -- লাল টকটকে একগুচ্ছ রক্তগ্যান্ধা ফুল তখুনো শক্তভাবে ধরা আছে।